শক কাটিয়ে উঠতে পারেননি মাশরাফি
সাইটস্ক্রিনের কাছেই বসে মাশরাফি। তাকে ঘিরে সাংবাদিকদের জটলা। দূরে দাঁড়িয়ে কয়েকজন ক্রিকেটার। আড্ডা শেষে মাশরাফির সঙ্গে একটা সেলফি তোলার আবদার সবার। বেশ কিছুদিন পর নড়াইল এক্সপ্রেসকে অনুশীলনে পেয়ে ক্রিকেটারদের অনেকেই অধিনায়কের কাছাকাছি থাকতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু এই আড্ডা, সেলফি তোলা কোনো কিছুই যেন আগের মতো জমছিল না। মাশরাফি থেকেও যেন নেই। একটু আনমনা ও দৃষ্টি উদাস। এর ভেতরেই সেলফি তোলার আবদার পূরণ করে গেলেন। কৌতূহল থেকে জানতে চাওয়া- শরীর ঠিক আছে তো? লড়াকু মাশরাফি যেন মাশরাফিতে নেই। আবেগে যেন টোকা পড়ল। নড়েচড়ে বসলেন। এরপর কথা বলা, 'শরীর ঠিকই আছে। মানসিকভাবে এখনও সেটেল না।'
মাশরাফি মানসিকভাবে সেটেল না! আঁতকে ওঠার মতোই। কিন্তু কেন? উত্তরে বললেন, 'হাঁটুতে একটু ব্যথা আছে। এ ছাড়া বিশ্বকাপের পরের কিছু ঘটনা ভুলতে পারছি না। মন থেকে কিছু জিনিস তাড়াতে পারছি না। পারব কি-না, তাও বুঝতে পারছি না।' মাশরাফি যে একজন লড়াকু ক্রিকেটার, তা কারও অজানা নয়। কোনো কিছুতেই ভেঙে পড়ার মানুষও নন তিনি। সেই তিনিই এখন বিমর্ষ। শরীরটা আছে কিন্তু ভেতরের মাশরাফি নেই। সেই প্রাণখোলা হাসি, প্রাণবন্ত আড্ডা, ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকা, সতীর্থদের ডেকে ডেকে দুষ্টামি করার আগ্রহটাই মরে গেছে তার।
দেশের সফল অধিনায়ক মাশরাফি। তার নেতৃত্বেই টানা দুটি বিশ্বকাপ খেলেছে বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ শেষে সাবেক প্রধান কোচ চান্দিকা হাথুরুসিংহে বলেছিলেন, 'বিশ্বের অন্যতম সেরা একজন অধিনায়ক মাশরাফি।' ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে অনেক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারই মাশরাফিকে সেরা অধিনায়কের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন প্রায়ই বলেন, 'অধিনায়ক মাশরাফির বিকল্প নেই।' বিশ্বকাপে কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ায় এবং টুর্নামেন্টে ছন্দে না থাকায় সমালোচনার তীরে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন নড়াইল এক্সপ্রেস। বিশ্বকাপের পর জাতীয় দল থেকে মাশরাফির অবসর দেখতে চেয়েছিলেন কেউ কেউ। অবসরের প্রশ্নে বিসিবির কাছ থেকে সময় চেয়ে নিয়েছেন তিনি। বিপিএলের 'এ' প্লাস ক্যাটাগরিতে দল পাচ্ছিলেন না। শেষে ঢাকা প্লাটুন মাশরাফিকে দলে নেয়। বঙ্গবন্ধু বিপিএলের শুরু থেকে ঢাকাকে নেতৃত্বও দিচ্ছেন তিনি। বোলিংটা সেভাবে ভালো করতে পারেননি। পারবেন কী করে, মনোযোগটাই তো দিতে পারছেন না খেলার মাঠে।
অবসর প্রশ্নের চেয়েও মাশরাফিকে বেশি 'শক' দিয়েছে ক্রিকেটারদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। যাদের সঙ্গে ২০ বছর ধরে ক্রিকেট খেলছেন, বিপদে-আপদে সতীর্থের পাশে দাঁড়িয়েছেন নেতার মতো করে, সেই তারাই জাতীয় দলের ওয়ানডে অধিনায়কের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। আন্দোলনে ডাকা দূরের কথা, জানানোরও প্রয়োজন বোধ করেননি জাতীয় দলের ঘনিষ্ঠ সতীর্থরাও। সাংসদ মাশরাফিকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন তারই দীর্ঘদিনের ক্রিকেট মাঠের সতীর্থরা। মাশরাফির দুঃখটা এখানেই, তিনি তো ক্রিকেট মাঠে সাংসদ নন, 'আমি তো ক্রিকেটার থেকেই সাংসদ হয়েছি। আমি তো ক্রিকেটের মাশরাফি। ক্রিকেটারদের মাশরাফি।' এই প্রশ্ন প্রতি মুহূর্তে তাড়া করে ওয়ানডে অধিনায়ককে। এর কোনো উত্তর খুঁজে পান না। বিশ্বাসের ভিতটাও তাই নড়ে গেছে। তাই তো তিনি এখন সুখ খোঁজেন নড়াইলের সাধারণ মানুষের মাঝে। গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে।
কোন মন্তব্য নেই