ল্যাটিন ‘ভাইরাস’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘বিষ’। এই বিষ যুগে যুগে মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। তেমনি যুগে যুগে মানুষ পরাস্ত করেছে এমন ভয়াবহ অতি আণুবীক্ষণিক শত্রুকে। আজ সমগ্র পৃথিবীর মানুষ উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে যে সুখবরের জন্য, তা হলো নভেল করোনাভাইরাসের কার্যকর প্রতিষেধক টিকা। এ মুহূর্তে একমাত্র এ খবরটিই পারে কোটি কোটি মানুষের জীবনে স্বস্তি এনে দিতে। বিজ্ঞানীরা বসে নেই, দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন এই মহা মূল্যবান ধন্বন্তরি হাতের মুঠোয় নেওয়ার জন্য। দুঃস্বপ্নের রাত একটু বেশি দীর্ঘ হয়। তার পরও বলা চলে, সেদিন আর নিশ্চয়ই বেশি দূরে নেই, সেই সুখবরটি আমরা পাব। তাই আসুন আজ ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের বিজয়ের গল্প শুনি।
গুটিবসন্ত
ডা. এডওয়ার্ড জেনার ১৭৯৬ সালের ১৪ মে গুটিবসন্তের প্রথম সফল প্রয়োগ করেন। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনসমারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি গুটিবসন্তের ভয়াবহতা অনেকেরই মনে থাকার কথা। বহু শতাব্দী ধরে গুটিবসন্ত ছিল এক বিশাল ত্রাসের নাম। গুটিবসন্তের ভাইরাসের নাম ভেরিওলা মেজর (Variola major)। এটি একবার সংক্রামিত হলে উজাড় হয়ে যেত লোকালয়। সরগরম জনবসতি পরিণত হতো মৃত নগরীতে, শবদেহের সৎকারের জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া সহজ হতো না। শুধু বিশ শতকেই গুটিবসন্তে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ। এতে আক্রান্ত হলে প্রতি ১০০ জনে ৩০ জনের মৃত্যু হতো। শিশুমৃত্যুর হার ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেত। যারা বেঁচে যেত, তাদের অনেকে হয় অন্ধ হয়ে যেত, নয়তো সারা জীবন শরীরে অস্বস্তিকর স্থায়ী দাগ বয়ে বেড়াত। আজ এই ভয়ংকর রোগটি আশ্রয় নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
ব্রিটিশ চিকিৎসক ডা. এডওয়ার্ড জেনার লক্ষ্য করছিলেন যে গোবসন্তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বিশেষ করে গোয়ালিনীরা গুটিবসন্তে আক্রান্ত হন না। ১৪ মে ১৭৯৬ তারিখে সারা নেলমস্ নামের এক তরুণীর হাতের গোবসন্তের তাজা গুটি থেকে খানিকটা তরল পুঁজ নিয়ে ৮ বছর বয়সী বালক জেমস ফিপসের শরীরে প্রবেশ করান জেনার। এরপর তিনি লক্ষ্য করলেন, বালকটি ৯ দিন হালকা জ্বর, কিছুটা অস্বস্তি এবং ক্ষুধামান্দ্যে ভুগে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছে। প্রায় দুই মাস পর জুলাইতে তিনি সেই বালকের দেহে বসন্তের তাজা তরল প্রবেশ করালেন। এবারে তিনি ব্যবহার করলেন ভয়াবহ আসল গুটিবসন্তের গুটি থেকে নেওয়া তরল রস এবং অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, বালকটি মোটেও গুটিবসন্তে আক্রান্ত হলো না। দুই মাস আগে তার দেহে প্রবেশ করানো গোবসন্তের পুঁজ বালকটির শরীরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তিনি নিশ্চিত হলেন যে অমূল্য মহৌষধের সন্ধান পেয়েছেন। এভাবে জন্ম নিল গুটিবসন্তের টিকা বা ভ্যাকসিন এবং ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালেন একজন মহামানব, তাঁকে বলা হলো ইমিউনোলজির জনক। তাঁর এমন যুগান্তকরী আবিষ্কারের পথ ধরেই পৃথিবী থেকে গুটিবসন্ত নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে, রক্ষা পেয়েছে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ।

ব্রিটিশ চিকিৎসক ডা. এডওয়ার্ড জেনার লক্ষ্য করছিলেন যে গোবসন্তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বিশেষ করে গোয়ালিনীরা গুটিবসন্তে আক্রান্ত হন না। ১৪ মে ১৭৯৬ তারিখে সারা নেলমস্ নামের এক তরুণীর হাতের গোবসন্তের তাজা গুটি থেকে খানিকটা তরল পুঁজ নিয়ে ৮ বছর বয়সী বালক জেমস ফিপসের শরীরে প্রবেশ করান জেনার। এরপর তিনি লক্ষ্য করলেন, বালকটি ৯ দিন হালকা জ্বর, কিছুটা অস্বস্তি এবং ক্ষুধামান্দ্যে ভুগে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছে। প্রায় দুই মাস পর জুলাইতে তিনি সেই বালকের দেহে বসন্তের তাজা তরল প্রবেশ করালেন। এবারে তিনি ব্যবহার করলেন ভয়াবহ আসল গুটিবসন্তের গুটি থেকে নেওয়া তরল রস এবং অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, বালকটি মোটেও গুটিবসন্তে আক্রান্ত হলো না। দুই মাস আগে তার দেহে প্রবেশ করানো গোবসন্তের পুঁজ বালকটির শরীরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তিনি নিশ্চিত হলেন যে অমূল্য মহৌষধের সন্ধান পেয়েছেন। এভাবে জন্ম নিল গুটিবসন্তের টিকা বা ভ্যাকসিন এবং ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালেন একজন মহামানব, তাঁকে বলা হলো ইমিউনোলজির জনক। তাঁর এমন যুগান্তকরী আবিষ্কারের পথ ধরেই পৃথিবী থেকে গুটিবসন্ত নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে, রক্ষা পেয়েছে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ।
জলাতঙ্ক

লুই পাস্তুর অনেক দিন আগে থেকেই এমন মারাত্মক রোগের প্রতিষেধক উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি রেবিস ভাইরাসে সংক্রামিত খরগোশের অস্থি-মজ্জা শুকিয়ে নিয়ে (দুর্বল) রেবিস ভাইরাসকে টিকা হিসেবে সংক্রামিত কুকুরের দেহে প্রয়োগ করে বেশ কিছু কুকুরকে সংক্রমণমুক্ত করেছিলেন। অনেকটা বিষে বিষক্ষয়। তিনি বুঝতে পারলেন, জলাতঙ্ক নিরাময়ে মহৌষধের সন্ধান তিনি পেয়েছেন। এখন বাকি শুধু মানবদেহে এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করা।
এদিকে সন্তানকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার একান্ত আশা নিয়ে একজন অসহায় মা যখন তাঁর দ্বারে এসে দাঁড়ালেন, তখন তিনি অনেকটা বাধ্য হয়েই বালকটির দেহে নিজের উদ্ভাবিত প্রতিষেধক প্রয়োগ করলেন। পরবর্তী কয়েক দিন ধরে নির্দিষ্ট মাত্রার প্রতিষেধক টিকা প্রয়োগ করে বালকটিকে সুস্থ করে তুললেন আর আতঙ্কগ্রস্ত মায়ের মুখে হাসি ফিরিয়ে আনলেন। আবিষ্কার হলো জলাতঙ্কের কার্যকর প্রতিষেধক টিকা, মানুষের হাতে পরাভূত হলো আরেকটি অতি ভয়ংকর ভাইরাসঘটিত রোগ।

এই ভয়ংকর ভাইরাসজনিত রোগের পুরো নাম পোলিওমাইলাইটিস। পোলিওতে আক্রান্ত হলে প্রাণে বেঁচে গেলেও মানুষকে পক্ষাঘাতের অভিশাপ বয়ে বেড়াতে হতো বাকি জীবন। এরা স্নায়ুতন্ত্রকে অকেজো করে ফেলত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এ ভাইরাসের শিকার ছিল বেশির ভাগ পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশু। তাই এর আরেকটি নাম হলো ‘শিশুদের প্যারালাইসিস’। এই রোগে আক্রান্ত শিশুর এক বা একাধিক অঙ্গ অবশ হয়ে যায়। শ্বাস-প্রশ্বাসের পেশি অবশ হলে শ্বাস বন্ধ হয়ে শিশুটির নির্মম মৃত্যু মা-বাবা, স্বজনদের প্রত্যক্ষ করতে হয়। শতকরা ৯৫ ভাগেরও বেশি পোলিও রোগীর দৃশ্যমান উপসর্গ দেখা যায় না।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইউরোপ ও আমেরিকায় পোলিওর প্রকোপ বৃদ্ধি পায় এবং জনমনে প্রচণ্ড আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পোলিও ভাইরাসের শিকার একজন বিখ্যাত ব্যক্তি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট। তিনি তখনো প্রেসিডেন্ট হননি, ১৯২১ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়স। পোলিওর কোনো চিকিৎসা তখনো না থাকায় এই ভাইরাসের আক্রমণে রুজভেল্টের পা দুটো পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে।
এমন অভিশপ্ত ভাইরাসকে পরাস্ত করতে এগিয়ে আসেন বহু বিজ্ঞানী। এর মধ্যে একজন হলেন জোনাস সাল্ক। ১৯৫৩ সালে পোলিও ভাইরাসের নিরাপদ এবং কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কার করে মানুষকে বিভীষিকামুক্ত করেন এ বিজ্ঞানী। সাল্ক প্রথম ফরমালিন ব্যবহার করে পোষক কোষে পোলিও ভাইরাসের বৃদ্ধি রোধ করেন। পরে এই ভাইরাস সুস্থ মানবদেহে প্রবেশ করিয়ে তিনি লক্ষ করেন, দেহ অ্যান্টিবডি প্রস্তুত করে পোলিওর বিরুদ্ধে চমৎকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। অতি বড় হৃদয়ের এই সাধক মানুষটি বিশ্ব মানবতার শত্রু পোলিওকে পরাভূত করার মোক্ষম অস্ত্র উদ্ভাবন করেও এ থেকে কোনো ফায়দা নেননি। এমনকি পোলিও টিকা নিজের নামে পেটেন্ট করেননি। আরেকজন বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট সাবিন, তিনি ইনজেকশনের পরিবর্তে ওরাল অর্থাৎ মুখে সেবনযোগ্য আরও সহজ এবং সাশ্রয়ী পোলিও টিকার উদ্ভাবন করেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮৮ সালে বিশ্বকে পোলিওমুক্ত করতে এক বিশাল উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ পোলিওর সংক্রমণ ৯৯ শতাংশের বেশি হ্রাস পায়। প্রতিবছর আক্রান্তের সংখ্যা ৩ লাখ ৫০ হাজার থেকে নেমে এসে ২০১৩ সালে মাত্র ৪১৬টি সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। এককালের বিভীষিকা পোলিও এখন ইতিহাসের এক বিস্মৃত অধ্যায়।
করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবের কালেও আমরা তা-ই আশা করতেই পারি, খুব দ্রুত পৃথিবীর কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো বিজ্ঞানী আমাদের আশার সংবাদ দেবেন।
তথ্যসূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, CDC, USA
লেখক: অণুজীববিজ্ঞানী এবং ফরাসি বিচার বিভাগে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন